পৃথিবীর একেক অঞ্চলের মানুষের চেহারা, চাল-চলন, কথাবার্তা, পোষাক-আষাকে লক্ষণীয় ভিন্নতা সুস্পষ্ট। আমাদের এই ছোট্ট দেশে ১৫/১৬ কোটি মানুষ বাস করে। এদের মাঝেও দেখা যায় নানান বৈসাদৃশ্য। তবে একটা বৈশিষ্ট পৃথিবীর সকল মানুষকে এক গ্রন্থিতে আবদ্ধ করেছে। এরা সকলেই স্তন্যপায়ী প্রাণী। মানুষ ছাড়া আরও অনেক স্তন্যপায়ী প্রাণী আমাদের চারপাশে দেখা যায়। মানুষ তাদের কারো মত নয়, আর কোন প্রাণীও মানুষের মত নয়। তা সত্ত্বেও সকল স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট দেখা যায়। মাতৃদুগ্ধ পান করা ছাড়া অন্যান্য বৈশিষ্টের মাঝে রয়েছে লোমাবৃত দেহ। শৈশবে মায়ের দুধ পান করে অথচ শরীরে লোম নেই এমন একটা প্রাণীও পাওয়া যাবে না সারা দুনিয়ায়। তিমি, ডলফিন, শুশুক প্রভৃতি স্তন্যপায়ী প্রাণী লোমহীন হলেও জীবনের প্রারম্ভে এদের লোম থাকে। যারা মায়ের দুধের উপরে নির্ভর করে শৈশব অতিবাহিত করে, মাতৃজঠরে তাদের শরীরটা গঠিত হয়ে আসে এমন ভাবে, যেন তারা জন্মের পরপরই মায়ের স্তন থেকে দুধ পান করতে পারে।
পাখিরা ডিম পাড়ে। একটা নির্দিষ্ট সময় তা দেবার পরে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। মা পাখি খাবার এনে বাচ্চাকে খাওয়ায়। সাপ, টিকটিকি, কুমীর, কচ্ছপ প্রভৃতি সরীসৃপ জাতীয় প্রাণীরাও পাখির মতই ডিম পাড়ে। কিন্তু এরা ডিমে তা দেয় না। এদের বাচ্চারা ডিম ফুটে বের হয়ে নিজেদের খাবার নিজেরা সংগ্রহ করে খেয়ে বড় হয়ে ওঠে। পাখির শরীরে একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রা রক্ষিত হবার ব্যাবস্থা আছে। কিন্তু সরীসৃপের তাপমাত্রা পরিবেশের তাপমাত্রার সাথে সাথে উঠানামা করে। তাই এদের ডিম ফুটাবার দায়িত্ব প্রকৃতি নিজের কাছেই রেখেছে। পাখি ও সরীসৃপের ডিমের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীন গঠনে তাই আছে বেশ অমিল।
আচ্ছা, এমন যদি দেখা যায়, কোন লোমবিশিষ্ট প্রাণী পাখির মত বাসা বানিয়ে সেখানে ডিম পাড়ছে! আবার সেই ডিমে একটা নির্দিষ্ট সময় তা দিয়ে বাচ্চা ফুটাচ্ছে! এর পরে আবার সে বাচ্চারা মায়ের দুধ পান করে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে! এরা কি পাখি? এরা কি সরীসৃপ? এরা কি স্তন্যপায়ী? কোন দলে এদের ফেলা যায়? থাক সে দলাদলির কথা। আমরা সেই প্রাণীটির সাথে পরিচিত হই আসুন।
পরিচিতির জন্য প্রথমে তাকে পেতে হবে তো কাছে! না সম্ভব নয়। অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের পূর্বাঞ্চলের কয়েকটা এলাকা ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও এদের টিকিটিরও সন্ধান পাওয়া যায় না। যদিও এদের কিছু আত্মীয়-স্বজন দক্ষিণ আমেরিকায় ফসিল হয়ে রয়ে গেছে। থাক, সে আর এক কাহিনী! এই যে ডিম দেওয়া লোম বিশিষ্ট স্তন্যপায়ী প্রাণী, এদের মাত্র পাঁচটি জীবিত প্রজাতির সন্ধান পাওয়া যায়। সকলেরই বসবাস অস্ট্রেলিয়ায়। এই পাঁচ প্রজাতির একটার নাম প্লেটিপাস, অপর চারটা প্রজাতি একিডনা (Echidna) গণের অন্তর্ভূক্ত। প্লেটিপাস (Ornithorhynchus anatinus)-এর হালচাল নিয়ে এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকে এই বিচিত্র প্রাণীদের সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা পাওয়া যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।


প্লেটিপাসের ঠোঁটের গড়ন ও আকৃতি আমাদের অতি পরিচিত হাঁসের মত। আর তাই এদের Duck-billed Platypus (ডাক-বিল্ড প্লেটিপাস) বলা হয়। মাত্র অল্প কয়েকটা বিষধর স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে প্লেটিপাস অন্যতম। প্লেটিপাসের শরীর ও চ্যাপ্টা লেজ ঘন বাদামী রঙের পানি নিরোধক লোম দ্বারা আবৃত। এদের চারখানা পা অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর মত বুকের দিকে সংযুক্ত নয়, বরং সরীসৃপের মত শরীরের উভয় পার্শ্বে ছড়ানো থাকে। পায়ের পাতা অনেকটা হাঁসের মত, আঙ্গুলগুলো পাতলা চামড়া দিয়ে পরস্পরের সাথে যুক্ত, যা সাঁতারে সহায়ক। এরা ডাঙার প্রাণী, কিন্তু পানিতেও এদের অসীম দক্ষতা (semiaquatic), সাঁতারে এদের দক্ষতা দারুন। নদীর কিনারার ঢালে মাটির অগভীর গর্তে এরা বাস করে। পুরুষ ও স্ত্রী প্লেটিপাসের মিলনের পরে স্ত্রী প্লেটিপাস অত্যন্ত তৎপরতার সাথে গর্তের গভীরতা বাড়িয়ে নেয়, এবং তা ৬০-৭০ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। গাছের পাতা ও অন্যান্য নানান কিছু দিয়ে বেশ নরম বাসা তৈরি করে দুই বা তিনটি ডিম পাড়ে। এদের ডিমের সাথে পাখির চেয়ে সরীসৃপের ডিমের সাদৃশ্য বেশি দেখা যায়। লম্বা ঘন লোমে আবৃত মোটা লেজ দিয়ে পেঁচিয়ে রেখে দশ দিন ডিমে তা দিলে বাচ্চা বের হয়।
সদ্য ফোটা বাচ্চা লোমহীন, চোখে কিছুই দেখে না, একেবারেই অসহায়। মায়ের দুধ খেয়ে এরা বড় হতে থাকে। প্লেটিপাসের স্তন বলে কোন কিছু নেই, এমন কী নেই কোন বোটাও। ত্বকের ছিদ্র দিয়ে দুধ বের হয়ে পেটের খাঁজ বেয়ে চুঁইয়ে পড়তে থাকে, সেখান থেকে বাচ্চারা সে দুধ চেটে চেটে খায়। তিন থেকে চার মাসের মধ্যে বাচ্চারা বেশ বড় হয়ে ওঠে। মা প্লেটিপাস তখন গর্ত ছেড়ে মাঝে মাঝে বাইরে যেতে থাকে। চার মাস বয়সের পরে বাচ্চারাও গর্তের বাইরে যাবার অনুমতি পায়। বাচ্চা প্লেটিপাস জন্মায় দাঁত নিয়ে, কিন্তু অচিরেই তারা দন্তশূন্য হয়ে পড়ে। চোঁয়ালের শক্ত পাত দিয়ে এরা খাদ্যবস্তু চিবানোর কাজ করে।

একিডনা (Echidna) অস্ট্রেলিয়ার প্রায় সর্বত্র পাওয়া যায়। Tachyglossus aculeatus সহ চারটি জীবিত প্রজাতি এদের প্রতিনিধিত্ব করছে। এদের আর এক নাম স্পাইনী এ্যান্ট ইটার (Spiny ant eater)। হ্যা, ঠিক ধরেছেন! এদের অন্যতম প্রধান খাদ্য হচ্ছে নানান জাতের পিঁপড়া। আর পিঁপড়া খাওয়ার জন্য এদের ঠোঁট বিশেষ ভাবে তৈরী। বেশ লম্বাটে ঠোঁট দিয়ে এরা গর্তের ভিতর থেকে পিঁপড়া বা অন্যান্য পোকামাকড় ধরে খায়। প্লেটিপাসের সাথে এদের প্রধান অমিল, এদের গায়ের কাঁটা। একিডনার শরীরও লোমে আবৃত, তবে লোম ছাড়াও সারা গায়ে থাকে সজারুর মত কাঁটা। এরাও ডিম পাড়ে, তা দিয়ে বাচ্চা ফোটায় এবং বাচ্চাকে দুধ খাইয়ে বড় করে তোলে।
জীবনের আবির্ভাব আর ক্রমবিবর্তন নিয়ে নানা মতবাদ আছে। এ নিয়ে হয়ে গেছে অনেক তর্ক-বিতর্ক। ক্রমবিবর্তনের অবশ্যম্ভাবী ধারার মতই এখনও চলছে এর পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি-পাল্টা যুক্তির প্রতিযোগিতা। প্রকৃতি মানব-সৃষ্ট নানান প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নীরবে তার কাজ করে চলেছে। কোন সুদূর অতীতে সরীসৃপ থেকে স্তন্যপায়ী প্রাণীরা ক্রমে আলাদা হয়েছিল, প্লেটিপাস আর একিডনা আজো তার ছাপ বয়ে নিয়ে চলেছে। প্রকৃতি এদেরকে এখনও পরিত্যাজ্য মনে করেনি।
No comments:
Post a Comment